ব্যাখ্যা
সংকলক হাদীসটি যাকাত ওয়াজিব ও তার ফযীলতের বর্ণনার অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। যে স্বর্ণ ও রৌপের মালিক এর হক আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার ঐ সোনা-রূপা দিয়ে তার জন্যে আগুনের অনেক পাত তৈরি করা হবে। অতঃপর তা জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তার ললাট, পার্শ্বদেশ ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই ঠাণ্ডা হয়ে আসবে পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে। আর তার সাথে এরূপ করা হবে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। তার এরূপ শাস্তি লোকদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। অতঃপর সে জান্নাত কিংবান জাহান্নামের পথ ধরবে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, সোনা ও রূপার উপর সর্বাবস্থায় যাকাত ওয়াজিব। কেউ যদি তার যাকাত না দেয় তাহলে তার শাস্তি সেরূপই হবে, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেন, “উটের মালিক যদি তার হক প্রদান না করে” অর্থাৎ উটের মালিকের উপর আল্লাহ যা ওয়াজিব করেছেন সেটা যদি না দেয় এবং তার পানি পান করার দিন দুধ দোহন করার সময় তা থেকে দান না করে, যেমন পথচারী ও পানি পান করতে আগমণকারীদের দুধ না দেয়, তবে কিয়ামতের দিন একটি সমতল ভূমিতে তাকে উপুড় করে শোয়ানো হবে। মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, দুনিয়াতে যেরূপ ছিল তার চেয়ে মোটা-তাজা করে আনা হবে। তার শাস্তি যেন বেশি হয়, তাই পশুগুলোকে এভাবে শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ রূপে গঠন করা হবে।এতে তাকে পা দিয়ে পিষার সময় এগুলোর ওজন বেশি হওয়ার কারণে সে বেশি কষ্ট পাবে। অনুরূপ শিং বিশিষ্ট পশুগুলোকে শিংসহ আনার কারণ হলো, যাতে তা দিয়ে আঘাত করে ও গোতা মেরে কষ্ট দিতে পারে। অতঃপর তিনি বলেন, “এভাবে যখন প্রথম পশুটি তাকে পা দিয়ে পিষে অতিক্রম করবে অপরটি অগ্রসর হবে”। মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, যখন শেষটির অতিক্রম করা শেষ হবে তখন প্রথমটিকে আবার আনা হবে। তাকে এভাবে পঞ্চাশ হাজার বছর শাস্তি দেওয়া হবে। যতক্ষণ না বান্দাদের মাঝে ফয়সালা করা হয়। অতঃপর সে তার ঠিকানা জান্নাত কিংবা জাহান্নাম দেখতে পাবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! গরু ও ছাগলের কী অবস্থা? তিনি বললেন, “যে গরু-ছাগলের মালিক তার হক আদায় করবে না, যখন কিয়ামতের দিন আসবে, তাকে এক সমতল ময়দানে উপুড় করে ফেলা হবে”। যারা উটের যাকাত দেয়া থেকে বিরত থাকে, তাদের ব্যাপারে যা কিছু বলা হয়েছে গরু-ছাগলের যাকাত দেয়া থেকে বিরত লোকদের ব্যাপারটিও সেরূপ। অতঃপর বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! ঘোড়ার ব্যাপার কী? তিনি বললেন, ঘোড়া তিন প্রকার। (ক) এটি কারো জন্য গুনাহর কারণ, (খ) কারো জন্য এটি আবরণ স্বরূপ এবং (গ) কারো জন্য এটি সাওয়াবের কারণ। অর্থাৎ ঘোড়া তিন প্রকার। প্রথম প্রকারের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, যেই ঘোড়া তার মালিকের জন্য গুনাহর কারণ, তা হচ্ছে যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য, অহংকার প্রকাশের জন্য এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করার উদ্দেশ্যে পোষে। এই ঘোড়া কিয়ামতের দিন তার উপর বোঝা হবে। আর দ্বিতীয় প্রকার বর্ণনা করেছেন নিম্নের বাণীতে: “যে ব্যক্তি তার ঘোড়াকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য পোষে এবং এর পিঠে আরোহন করে এবং খাবার ও ঘাস দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর হক ভুলে না। এ ঘোড়া তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখার জন্য আবরণ হবে”। " অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে ঘোড়া লালন করে এবং তা দ্বারা মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে নিজেকে বাচানার জন্য সেটার বাচ্চা, দুধ, তার উপর বোঝা উঠিয়ে ও সেটা ভাড়ায় খাটিয়ে উপকৃত হয়, তার কাজ আল্লাহর আনুগত্য ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। এই ঘোড়া তার জন্যে আবরণ হবে। কারণ মানুষের নিকট যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অন্যদের নিকট হাত পাতা হারাম। তিনি আরো বলেন, “অতঃপর সে তার পিঠ ও খাবারের ক্ষেত্রে তার হক ভুলেনি, যেমন আল্লাহর রাস্তায় ও নিজের প্রয়োজনে তার উপর আরোহন করে, তার সামর্থের বাইরে তার উপর বোঝা চাপায় না, তার সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং তার ক্ষতি দূর করে। এই ঘোড়া অভাব থেকে তার জন্যে আবরণ স্বরূপ। তৃতীয় প্রকার ঘোড়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “আর যে ব্যক্তি মুসলিমদের সাহায্যের জন্য আল্লাহর রাস্তায় ঘোড়া পোষে এবং কোন চারণভূমি বা ঘাসের বাগানে লালন করে, তার জন্য এ ঘোড়া সাওয়াবের কারণ হবে। তার ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানে যা কিছু খাবে, তার সমপরিমাণ সওয়াব তার জন্য লেখা হবে।এমনকি এর গোবর ও পেশাবেরও সাওয়াব লেখা হবে। আর যদি তা রশি ছিড়ে একটি বা দুটি মাঠও বিচরণ করে তাহলে তার পদচিহ্ন ও গোবরের সমপরিমাণ ছাওয়াব তার জন্য লেখা হবে। এর মালিক যদি একে কোন নদীর তীরে নিয়ে যায়, আর সে নদী থেকে পানি পান করে অথচ তাকে পানি পান করানোর ইচ্ছা মালিকের ছিল না, তথাপি পানির পরিমাণ সাওয়াবতার জন্য লেখা হবে। অর্থাৎ জিহাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে। চাই সে নিজে তাতে আরোহন করে জিহাদ করুক কিংবা তার উপর আরোহন করে কাফিরদের সাথে মুজাহিদরা জিহাদ করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি জিহাদ করার জন্য কাউকে প্রস্তত করে দেয় সেও জিহাদ করে”। এই ব্যক্তি তার ঘোড়াকে আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য তৈরি করে রেখেছে। তাই এই ঘোড়া যত ঘাস খাবে তার সাওয়াবও সে পাবে।এমন কি তার পেশাব ও গোবরেরও সাওয়াব মিলবে। তোমার রব কারো উপর যুলুম করেন না। তিনি আরো বলেন, “এমনকি সেটি যদি তার রশি ছিড়ে একটি বা দুটি টিলা অতিক্রম করে তাহলে তার পদচিহ্ন ও গোবরের সমপরিমাণ ছাওয়াব তার জন্য লেখা হবে”।অর্থাত নির্দিষ্ট জায়গায় ঘাস খাওয়ার জন্য ঘোড়াকে যেই রশি দিয়ে বেধে রাখা হয়, তা ছিড়ে যদি অন্য স্থানে চলে যায়, সেখানে তার পদচিহৃ, তার গোবর ও পেশাবের সমপরিমাণ ছাওয়াব লিখা হবে। তিনি আরো বলেন, “এর মালিক যদি একে কোন নদীর তীরে নিয়ে যায়, আর সে নদী থেকে পানি পান করে অথচ তাকে পানি পান করানোর ইচ্ছা মালিকের ছিল না, তথাপি পানির পরিমাণ সাওয়াব তার জন্য লেখা হবে”। অর্থাৎ ঘোড়া যে নদী বা ঘামলা থেকে পানি পান করে মালিককে তার বিনিময়েও সাওয়াব দেওয়া হবে। যদিও সে তাকে পান করানোর নিয়ত না করে। ঘোড়া যত পানি পান করবে তার বিনিময় তাকে সাওয়াব দেওয়া হবে, যদিও সে তার নিয়ত না করে। পূর্বের নিয়তই তার জন্যে যথেষ্ট। আর সেটা হচ্ছে তাকে আল্লাহর রাস্তায় তৈরি করে রাখার নিয়ত। অতএব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কাজেই নিয়ত থাকা আবশ্যক নয়। যদি তার উদ্দেশ্য থেকে বের না হয়। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! গাধার অবস্থা কী? অর্থাৎ তার হুকুম কী? সেটা যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে চতুষ্পদী জন্তুর বিধান গ্রহণ করবে, না ঘোড়ার বিধান গ্রহণ করবে? তিনি বললেন, অর্থাৎ গাধার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে আমার উপর কিছু্ই নাযিল হয়নি। তবে এই অর্থবহ আয়াতটি নাযিল হয়েছে, যা প্রত্যেক ধরনের কল্যাণকে শামিল করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, فمن يعمل مثقال ذرة خيرا يره ومن يعمل مثقال ذرة شرا يره“যে ব্যক্তি এক অণু পরিমাণ ভাল কাজ করবে সে তার সুফল পাবে আর যে এক অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সেও তার মন্দফল ভোগ করবে”। (সূরা যিলযাল, আয়াত:৭-৮) হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। যদিও এখানে বর্ণিত শব্দ মুসলিম থেকে গৃহীত। এই আয়াত প্রত্যেক কল্যাণকর ও অকল্যাণকর জিনিষকে অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ সে যখন দেখবে অণু পরিমাণ বস্তুও লিপিবব্ধ আছে, যা সবচেয়ে ছোট বস্তু এবং তার বিনিময় লাভ করবে, তাহলে তো তার চেয়ে বড় জিনিসের প্রতিদান অবশ্যই পাবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, يوم تجد كل نفس ما عملت من خير محضرًا وما عملت من سوء تَوَدُّ لو أن بينها وبينه أمدا بعيدا“যেদিন প্রত্যেকে উপস্থিত পাবে যে ভাল আমল সে করেছে এবং যে মন্দ আমল সে করেছে তা। তখন সে কামনা করবে, যদি মন্দ কাজ ও তার মধ্যে বহুদূর ব্যবধান হত! [সূরা আল-ইমরান, আয়াত:৩০]